রবিবার ১৯ মে ২০২৪
Online Edition

কারা হেফাজতে ৯ বছরে ৫৫৫ বন্দীর মৃত্যু 

নাছির উদ্দিন শোয়েব : দেশের কারাগার এখন বিরোধী মতের নেতা-কর্মীদের জন্য আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিরোধী নেতা-কর্মীরা কারাগারকে নিরাপদ বোধ করছেন না। উদঘাটিত হচ্ছে না কারা হেফাজতে মৃত্যুরহস্য। বিএনপি ও জামায়াতের বহু নেতাকে দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছে। আটক রয়েছেন শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতাও। অভিযোগ রয়েছে, কারা অভ্যন্তরে নানা কায়দায় নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তারা। ইতোমধ্যে পাঁচজন নেতার মৃত্যু হয়েছে কারাগারে। 

কারাবন্দীদের স্বজনদের অভিযোগ, শীর্ষ নেতাদের আটকের পর রিমান্ড-নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অনেকে। এ ছাড়াও তাদেরকে বিনা চিকিৎসায় শারীরিকভাবে গুরতর অসুস্থ করে ফেলা হচ্ছে। এমনকি জেল কোডের প্রাপ্ত সুযোগটুকু থেকেও বঞ্চিত করা হচ্ছে তাদেরকে। সর্বশেষ গত শনিবার সকালে গাইবান্ধায় কারাবন্দী অবস্থায় জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক গাউসুল আজম ডলার (৫০) মারা গেছেন। 

বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার তথ্য অনুযায়ী গত নয় বছরে দেশের বিভিন্ন কারাগারে ৫৫৫ জন বন্দীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে অনেকে হাসপাতালে ভর্তির পর আবার কেউ কেউ কারাগারেই প্রাণ হারিয়েছেন। এ সময় অসুস্থ হয়েছেন কয়েক হাজার বন্দী। অভিযোগ রয়েছে- কারাগারে গুরুতর অসুস্থ হলেও উন্নত চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছেন না বন্দীরা। শীর্ষ রাজনৈতিক দলের নেতারা দীর্ঘদিন কারাগারে আটক থেকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের উন্নত চিকৎসা না দেয়ার অভিযোগ করেছেন তাদের স্বজনরা। চিকিৎসা না পেয়ে অনেক বন্দী ধুঁকে ধুঁকে কারাগারেই মারা যাচ্ছেন। 

মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্য অনুযায়ী ২০০৮ সাল থেকে ২০১৬ সালের নবেম্বর পর্যন্ত প্রায় নয় বছরে দেশের বিভিন্ন কারাগারে থাকাকালে ৫৫৫ জন বন্দীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২০০৮ সালে ৬৬, ২০০৯ সালে ৫০, ২০১০ সালে ৬০, ২০১১ সালে ১০৫, ২০১২ সালে ৬৩, ২০১৩ সালে ৫৯, ২০১৪ সালে ৫৪ ও ২০১৫ সালে ৪৯ জন ও ২০১৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে ৪৯ জন বন্দীর মৃত্যু হয়েছে। 

উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকার পরও বিরোধী মতের নেতাদের কারাগারে সুচিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না এমন অভিযোগ বন্দীর স্বজনদের। এপরও তাদের এক কারাগাগার থেকে অন্য কারাগারে স্থানান্তর ও আদালতে হাজিরা দেয়াতে দূরের পথে অসুস্থ বন্দীর শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করা হয় না। ফলে কারাগারগুলো এক ধরনের টর্চার সেলে পরিণত হয়েছে বলে ভুক্তভুগি ও স্বজনরা বিভিন্ন সময় অভিযোগ করেছেন। কারা হেফাজতে মৃতদের স্বজনদের অভিযোগ, সরকার বিরোধী আন্দোলন দমনে পুলিশ প্রশাসন সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে নেমেছে। পুলিশ পরিকল্পিতভাবে বিএনপি-জামায়াত তথা বিরোধী নেতাকর্মীদের নামে একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদেরকে কারাগারে পাঠাচ্ছে। অন্যদিকে কারাগারে আটক নেতাকর্মীরা অসুস্থ হলে তাদের সুচিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না। 

গত শনিবার কারা হেফাজতে মৃত্যুবরণ করা গাইবান্দার বিএনপি নেতা গাউসুল আজম শহরের পলাশবাড়ী এলাকার অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আফতাব উদ্দিন আহমেদের ছেলে। তিনি ২০০৯ সালে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। স্ত্রী ও দুই ছেলে সন্তান রয়েছে তার। গত ৫ অক্টোবর একাধিক মামলায় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। পুলিশের দাবি, গাউসুল আজম শনিবার ভোরে হৃদরোগে আক্রান্ত হন। পরে তাকে গাইবান্ধা আধুনিক হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। সদর থানার ওসি একেএম মেহেদী হাসান জানান, গাউসুল আজম ভোরে বুকে ব্যথা অনুভব করেন। পরে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। জেলা বিএনপির সাংগঠনকি সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান মিজান জানান, গাউসুল আজমের আগে থেকেই হার্টের সমস্যা ছিল। 

এর আগে রাজশাহী কারাগারে মর্মান্তিক মৃত্যুবরণ করেন বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু। তিনি বিডিআর বিদ্রোহ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ছিলেন। পরিবারের অভিযোগ, পিন্টুকে পরিকল্পিতভাবে কারাগারে হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়াও কারাগারে গুরুতর অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর বর্ষিয়ান রাজনীতিক অধ্যাপক গোলাম আযম। গোলাম আযমকে মানবতা বিরোধী মামলায় আটক করে সাজা দেয় যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আটকের পর থেকেই তিনি গুরুতর অসুস্থ ছিলেন। এর আগে কারাগারে আটক থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন জামায়াতের সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা একেএম ইউসুফ। অপরদিকে যুদ্ধাপরাধ মামলায় আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আব্দুল আলীম মারা গেছেন প্রিজন সেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায়। এখনো কারাগারে জামায়াতের অধিকাংশ নেতা গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় আছেন। যাদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী থাকার কথা তারা বিনা চিকিৎসায় কারাবন্দী আছেন বলে অভিযোগে প্রকাশ। এ অবস্থায় নেতাদের কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে এর দায় সরকারকেই বহন করতে হবে বলে জানিয়েছেন দলীয় নেতারা।

এছাড়াও কারাগারে আটক দৈনিক আমার দেশ এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান দীর্ঘ দিন ধরে অসুস্থ অবস্থায় আছেন। সম্প্রতি উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়েও এখনো মুক্তি মেলেনি তার। এছাড়াও নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না গুরুতর অসুস্থ বলে জানিয়েছেন তার স্বজনরা। তিনিও উচ্চ আদালত থেকে সম্প্রতি জামিন পেয়েছেন। সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, আল্লামা দেলেয়ার হোসাইন সাঈদী, বরোধী জোটের কয়েক ডজন শীর্ষ নেতা বর্তমানে কারাগারে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় আছেন। কারাগারে আরো আটক রয়েছেন, শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানসহ বেশ কয়েকজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও বিডিআর বিদ্রোহ মামলার সাজাপ্রাপ্ত জওয়ানরা। 

অভিযোগ রয়েছে, জীবন-মরণ সন্ধিক্ষণে তারা দিন যাপন করলেও-কারা কর্তৃপক্ষ তাদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এমনকি কারাগারে গুরুতর অসুস্থ বা অচেতন হয়ে গেলে লোক দেখানোভাবে বাইরের হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে আবার কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শকেও তোয়াক্কা করছে না কর্তৃপক্ষ। কতিপয় কারা কর্মকর্তা জেল কোডের চেয়ে সরকারের মর্জিকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। 

জানা গেছে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী ঐক্য জোটের প্রথম সারির নেতাসহ বিরোধী জোটের চার হাজারেরও বেশি নেতাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ